রাজশাহী কলেজ লাইব্রেরিঃ ঐতিহ্যের সাঁকো

“মহাসমুদ্রের শত বত্সরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত৷…. মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে৷….. কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে৷….. অতলস্পর্শ কালসমুদ্রের উপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে।” বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গাব্দ ১২৯২, পৌষে রচিত তাঁর লাইব্রেরী প্রবন্ধে যথার্থ বলেছেন।

হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) এর পরশধন্য ও অতীতের প্রবহমান ও শক্তিমান পদ্মার স্মৃতি বিজড়িত শান্তিময় নগরী রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্রে সার্ধ শতাব্দীর দ্বার প্রান্তে উপনিত এই ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ অবস্থিত। ১৮৭৩ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে কলেজ লাইব্রেরি তার কার্যক্রম শুরু করেছিল কিনা সে বিষয়ে কোন দালিলিক প্রমাণ না পাওয়া গেলেও জানা যায় যে, কলেজ শুরুর প্রথম বছরে ক্লাশসমূহ তত্কালীন কলেজিয়েট স্কুলে অনুষ্ঠিত হত এবং পরবর্তীতে নিজস্ব ভবন তৈরী হলে বেশ কিছু সংখ্যক পুস্তক, দলিল-দস্তাবেজ এবং সরকারী রিপোর্ট স্থানান্তরের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে লাইব্রেরী কার্যক্রম শুরু হয়। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নূতন রেগুলেশনের নির্দেশনায় একটি ভাল মানের লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে ১৯১০ সালে কলেজে তত্কালীন ‘কমনরুম’ ভবরে ছোট তিনটি কক্ষ নিয়ে লাইব্রেরির কার্যক্রম নিয়মিত ভাবে শুরু হয়৷ যদিও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শকবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে (১৯০৮-১৯১২) এই কলেজের লাইব্রেরির আকার, অবস্থান ও পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ দায়ের এবং একজন শিক্ষিত, প্রজ্ঞাবান এবং বিদ্যোত্সাহী (… who must be at least aman of education and intelligence so that he could to a certain extent guide the students in thier studies…) ব্যক্তিকে লাইব্রেরিয়ান পেশায় নিয়োগের পরামর্শ প্রদান করেছিলেন। যা কার্যকর করতে তৎকালীন অধ্যক্ষবৃন্দের বেশ কিছু বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে ১৯১৭-১৯১৮ সালে লাইব্রেরি সংগ্রহে ১০,০১২ খানা পুস্তক এবং পরবর্তীতে ১৯২০ সালে ১০,২৭৫ খানা পুস্তক যা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি গ্রহণযোগ্য সংখ্যা বলে ধরে নেয়া হয়৷

রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগারে বহু মূল্যবান ও প্রাচীন গ্রন্থসহ সংস্কৃত, বাংলা পুঁথি ও সাময়িকী সংরক্ষিত আছে৷ ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গ্রন্থাগারে পুস্তক ক্রয়ের জন্য মাত্র চার হাজার টাকা বাৎসরিক বরাদ্দ ছিল এবং পুস্তক বাধাইয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র দুই শত টাকা৷ যদিও সেই সময় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম থাকা সত্ত্বেও ঢাকা কলেজ এবং চিটাগাং কলেজে পুস্তক ক্রয়ের জন্য অধিক অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হত। ১৯৩৫ সালের রাজশাহী কলেজ রিপোর্টে দেখা যায় পাঁচ টাকা হারে জামানত প্রদানপূর্বক গ্রন্থাগার থেকে ছাত্ররা পুস্তক গ্রহণ করতে পারতো। বর্তমানে বৎসরে প্রায় তিন লক্ষ টাকার বই-পুস্তক, সাময়িকী এবং পত্র-পত্রিকা ক্রয় করা হয়ে থাকে।

ডঃ জেঙ্কিনস্ (১৯৩২-৩৩) অধ্যক্ষের দায়িত্ব অর্পণ করার সময় ছেষট্টি খণ্ড (Volumes) মূল্যবান পুস্তক গ্রন্থাগারে দান করেছিলেন৷ কলেজ গ্রন্থাগারে প্রাপ্ত Catalogoue of books in Rajshahi College Library 1939, 1942, তত্কালীন সরকার কর্তৃক প্রকাশিত হয়৷ উল্লিখিত ক্যাটালগে “The rajshahi College Library contains nearly 25,000 volumes of books and a good collection of periodicals.

রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগারে সংস্কৃত ভাষায় লেখা পাঁচ শতাধিক প্রাচীন পুঁথি রয়েছে৷ সংস্কৃত সাহিত্যের বেদ, পুরাণ, মহাকাব্য, কাব্য, তন্ত্র ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই পুঁথিগুলো লেখা৷ এই পুঁথিগুলোর অধিকাংশই দেশীয় উপকরণের সাহায্যে প্রস্তুত, হাতে তৈরি তুলোট কাগজে লেখা৷ এর কাগজ হরিতাল, অভ্র ইত্যাদির প্রলেপ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে৷ পুঁথিগুলো হরিতকি, হিঙ্গুল, অঙ্গার, ছাগদুগ্ধ, জবার কুড়ির সাহায্যে প্রস্তুত দেশীয় কালিতে লেখা৷ কালির রং ঘন কালো এবং দীর্ঘস্থায়ী। কঞ্চি, শর, ময়ূর বা শকুনের পালক দিয়ে তৈরি কলমে পুথিগুলো লেখা। পুথিগুলোর লিপিকাল যথাক্রমে শকাব্দ, সম্বত্ ও সনে লেখা৷ পুঁথিগুলো সেলাইবিহীন, কাঠের পাটাতনে বাঁধা রয়েছে৷ কোনটিতে পৃষ্ঠাঙ্ক দেয়া আছে৷ কোনটি আবার পৃষ্ঠাঙ্কবিহীন৷

বর্তমানে সুবিশাল লাইব্রেরিটি রাজশাহী কলেজের ঐতিহ্যের একটি অন্যতম ধারক। অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য পুস্তক, পুঁথি ও সাময়িকীতে সমৃদ্ধ এই লাইব্রেরিটি কলেজের প্রশাসন ভবনের পশ্চিমে অবস্থিত৷ লাইব্রেরিতে সংগৃহীত পুস্তকের সংখ্যা প্রায় আঠাত্তর হাজার৷ প্রতি দিন গড়ে ৫০০ জন ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকবৃন্দসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষকবৃন্দ এই লাইব্রেরিতে পড়াশুনার জন্য নিয়মিত আসেন৷ সম্প্রতি প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস করে পাঠযোগ্য স্থান সম্প্রসারণ এবং আসবাবপত্র সরবরাহ করে লাইব্রেরি ব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধি করে হয়েছে৷ লাইব্রেরির অভ্যন্তরীণ অংশ সংস্কার করে পাঠ পরিবেশ অধিকতর উন্নত করা হয়েছে৷ আধুনিক ব্রড ব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা স্থাপনের মাধ্যমে লাইব্রেরিটি তথ্যবিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে৷ এতে করে ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্ক তাৎক্ষণিকভাবে জানাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল প্রাপ্তি এবং শিক্ষা প্রশাসনের জরিকৃত সর্বশেষ তথ্য পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

আজীবনকাল বিশ্বজনীন শিক্ষায় সহায়তা, মানুষের লব্ধ যাবতীয় জ্ঞান ও সংস্কৃতি অনুধাবনে সকলকে সামর্থ্য করে তোলা, লিপিবদ্ধ চিন্তাভাবনা এবং সৃজনশীল কল্পনাশক্তি সকলের কাছে পরিবেশন, শ্রান্তির নিরসন ও চিত্তবিনোদন কল্পে বই ও অন্যান্য মাধ্যমে মানসিক উত্কর্ষ সাধারন, কারিগরি, বৈজ্ঞানিক এবং সমাজবিজ্ঞান বিষয়াদির সর্বাধুনিক তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা প্রদানে রাজশাহী কলেজ লাইব্রেরি তার অনন্য ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে পালন করে আসছে৷ যা অতীত এবং বর্তমানের মাঝে সাঁকো হিসাবে মানব সমাজের ভবিষ্যত্ আলোর পথ রচনা করে চলেছে৷

মুহাম্মদ মহিউদ্দীনগ্রন্থাগারিক রাজশাহী কলেজ, রজাশাহী৷